- 11 August, 2023
- 0 Comment(s)
- 204 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
কতগুলি ইংরেজি শব্দ এদিক সেদিকে উড়ে বেড়ায়। কিছু কিছু কানে আসে। আবার আসেও না বোধহয়। আবার কখনও কখনও এমনই একেকটি শব্দ কানে জোরালো হয়ে ওঠে। যেমন, এখন যে শব্দগুলি মাথায় ঘুরছে সেগুলি হল empathy, compassion, whataboutery ইত্যাদি। ইংরেজি একটি প্রবাদও এই সূত্রে মনে পড়ছে, যা কিনা স্কুলে থাকতে পড়েছিলাম। আলোচনায় কোনও বিষয়কে বারংবার এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল বা প্রবণতাকে বলা হত beating around the bush, কোনও স্পর্শকাতর বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠলেই রাজনীতিকেরা যা হামেশাই করে থাকেন। এই নিবন্ধে রাজনীতির প্রসঙ্গ নিঃসন্দেহে আসবে। কিন্তু চেষ্টা থাকবে রাজনীতিকে অতিক্রম করেই বিষয়টিকে তুলে ধরার।
মণিপুর, ২০২৩। যে সমস্ত ঘটনাকে গত মে মাস থেকে রাজ্য হিসেবে মণিপুর প্রত্যক্ষ করেছে, সেসবের প্রসঙ্গে বিস্তারিত বিবরণ বিবিধ জায়গাতে প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে আমারও কিছু কিছু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া এখানে ও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে উঠে এসেছে। অন্যতম ভারতীয় রাজনীতিক ও কেন্দ্রীয় আইনসভার বর্তমান সদস্য হিসেবে অন্যতম বিরোধী মুখ, শ্রী রাহুল গান্ধী নিজে সে রাজ্যে গিয়েছেন ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে আইনসভার ভিতরে ও বাইরে বিবিধ উপায়ে বারংবার সেই প্রসঙ্গ উত্থাপনের চেষ্টা করেছেন। এর ফলে তাঁকে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজনৈতিক দল হিসেবে বিজেপি’র লাগাতার আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে। এই মুহূর্তে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবর থেকে যতটুকু জানা যাচ্ছে, মে ২০২৩ থেকে আজ অবধি জারি থাকা মণিপুরের এই হিংসার কারণে অন্ততপক্ষে ১৮০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সে রাজ্যের পাহাড় ও সমতলের অধিবাসীদের মধ্যে কার্যত এক অঘোষিত বিভাজনরেখা অঙ্কিত হয়েছে। সে রাজ্যের জাতি-উপজাতিগত যে জটিল বিভাজন ও জনসংখ্যাবিন্যাস, সেই তথ্যকে মাথায় রেখে ঘটনাপরম্পরার যে তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন, তার পরিসর এটা নয়। সেই প্রসঙ্গে আরও অন্য কোনও নিবন্ধে লিখব। কিন্তু চূড়ান্ত হিংসা ও নারীর উপরে অত্যাচারের ক্ষেত্রে যে সমস্ত বিবরণ মণিপুরের সীমানা টপকিয়ে আমাদের কাছে এসেছে, তার পরবর্তীতে যে কোনও সভ্য দেশেরই সরকারের তরফে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন ছিল। তেমন কোনও পদক্ষেপ সরকারের তরফে চোখে পড়েনি। এমনকি মণিপুরের হিংসা যখন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে অবধি প্রকাশিত হতে শুরু করেছে, ঠিক সেই সময়েই আমাদের আদরণীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয় একাধিক বিদেশ সফরে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। কতখানি নিপুণতা ও পূর্ব-পরিকল্পনা মোতাবেক এই দেশে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরু জনতাকে উসকিয়ে দেবার চেষ্টা করছে, মণিপুরের ঘটনা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। কারণ, বিভিন্ন তদন্তমূলক সংবাদ-প্রবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, এবছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই মণিপুরের সংখ্যাগুরু মেইতেইদের তরফে রাজ্যের সমতল এলাকাগুলিতে সংখ্যালঘু কুকিদের ব্যবসা-বাসস্থান ইত্যাদিকে চিহ্নিতকরণের কাজ শুরু হয়েছিল। সম্প্রতি একই কায়দাতে উত্তরাখণ্ডেরও একাধিক জায়গা থেকে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের তরফে এলাকার মুসলিম বাসস্থান ও ব্যবসা-দোকান ইত্যাদিকে একই রকম ভাবে চিহ্নিতকরণের অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। এরই পরবর্তীতে হিন্দি-বলয়ের রাজ্যগুলিতে নেমে এসেছে বুলডোজারের বিচারপ্রক্রিয়া। মণিপুরের ক্ষেত্রে তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে খোলাখুলি জাতিগত সংঘর্ষে, তফাত বলতে কেবল এইটুকুই।
মণিপুরের ঘটনাবিন্যাসের দীর্ঘ আলোচনায় না গিয়ে আমরা বরং আবারও compassionএরই আলোচনাতে ফিরি। কোনও মানুষ, জাতি বা গোষ্ঠী, যখন তীব্র সন্ত্রাসের মুখে পড়ে, তখন যে কোনও স্বাভাবিক মানুষেরই তরফে তার প্রতি, তাদের প্রতি যে প্রতিক্রিয়া উঠে আসা উচিত তার বৈশিষ্ট্য হল সহানুভূতি ও সহমর্মিতা, ইংরেজিতে empathy ও compassion। মণিপুরের ক্ষেত্রে মহিলা ও শিশুদের উপর যে নারকীয় অত্যাচার নেমে এসেছে, বা দেশের অন্যান্য জায়গাতেও যেখানে যেখানে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, সবকটি ক্ষেত্রেই অত্যাচারের নৃশংসতম রূপকে প্রত্যক্ষ করেছেন সেই অঞ্চলের শিশু ও মহিলারাই। যেমন ধরা যাক, সদ্য ঘটে যাওয়া হরিয়ানার নূহ ও গুরুগ্রামের সংঘর্ষের ঘটনার ক্ষেত্রে, আরও ছোট্ট কয়েকটি ঘটনাকেই এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল। ঘটনার আগে বা পরের কোনও এক সময়, নূহের বাসিন্দা জনৈক মুসলিম ভদ্রলোক সংবাদমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, “সেদিন হঠাৎই হিন্দু-জনতার একটি দল, বজরং দল অথবা বিশ্ব হিন্দু পরিষদেরই তারা সদস্য, আমার ত্রিশ বছরের পুরনো দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে অকথ্য ভাষায় হুমকি ও গালিগালাজ করতে থাকে। আমি নিজে শান্ত থাকি, ও প্রতিবেশীদেরকেও শান্ত থাকতে বলি। তারা চলে যাওয়ার পর আমার ছোট্ট মেয়ে হঠাৎ আমার কাছে ছুট্টে চলে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা, ওরা তোমায় অমন ভাবে বকছিল কেন? তুমি কি কোনও খারাপ কাজ করেছ?’ আমি ওর কথার কোনও জবাব দিতে পারিনি। ওর বোধহয় এখনই হিন্দু-মুসলমান বুঝে ফেলার বয়স হয়নি। আমি নিশ্চুপে ওকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েছিলাম।” এ কোন শৈশব আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাচ্ছি বলতে পারি না। মণিপুরের গণধর্ষণ ও নগ্ন অবস্থায় দুই কুকি রমণীকে প্রকাশ্যে হেনস্থা করার যে ভিডিও সামনে এসেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে সে রাজ্যে শিশু ও মহিলাদের বর্তমান অবস্থা কেমন, তাকে হৃদয়ঙ্গম করতে বোধহয় কোনও ‘rocket science’এ বোঝার প্রয়োজন পড়ে না। এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর যখন নীরব, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক কার্যক্ষেত্রে কোনও ব্যবস্থা নিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ, তেমন এক সময়ে বোধহয়, অন্ততপক্ষে নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রকের তরফে অথবা জাতীয় শিশু ও মহিলা কমিশনের তরফে সামান্যতম সহানুভূতি (empathy) ও সহমর্মিতা (compassion)এর বার্তা আসা উচিত ছিল, অন্তত এমনটাই আমরা ভেবেছিলাম।
আমরা সেই প্রতিক্রিয়া পাইনি। আমরা অবাক হয়ে জেনেছি, কুকি মহিলাদের নগ্ন করে প্রকাশ্য হেনস্থার ছবি ও ভিডিও জাতীয় মহিলা কমিশনের দপ্তরে, প্রকাশ্যে আসার প্রায় তিন সপ্তাহ আগে গিয়ে পৌঁছলেও, তাঁরা কেবল মণিপুর পুলিশকে একটি সরকারি চিঠির মাধ্যমে ‘এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে’ হাত ধুয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। কমিশনের এক সদস্য, প্রাক্তন অভিনেত্রী ও বর্তমান রাজনীতিক খুশবু সুন্দর, হেনস্থার ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার দিনেও, নিজের নাচের ভিডিওকে সামাজিক মাধ্যমে ভাগ করে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এঁরাই এদেশে নারীর অধিকার রক্ষার কাজে নিয়োজিত। ব্যতিক্রম যে নেই তা বলব না। ঘটনাটি সামনে আসার সামান্য কিছুদিনের মধ্যেই দিল্লী মহিলা কমিশনের চেয়ারম্যান স্বাতী মালিওয়াল মণিপুর গিয়ে আক্রান্ত মহিলাদের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে অস্বীকারের চেষ্টা ও বিষয়টিকে লঘু করে দেখানোর যে ঘৃণ্য উদ্যোগ, তার সবকিছুকেই বোধহয় ছাপিয়ে গিয়েছে – সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রীর প্রকাশ্য আচরণ। যে মন্ত্রীর নাম স্মৃতি জুবিন ইরানি, মণিপুরের ঘটনা থেকে নজর ঘোরাতে যাঁর আচরণ নিকৃষ্টের চেয়েও নিকৃষ্ট পর্যায়ে নেমে গিয়েছে।
দীর্ঘ নীরবতার পর অবশেষে বিরোধীদের লাগাতার আক্রমণের মুখে পড়ে শ্রীমতি ইরানি প্রথম থেকেই গতানুগতিক whataboutery অথবা প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল নিয়েছিলেন। বিভিন্ন রাজ্যের কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা তুলে এনে, সেই সব ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলি কি ব্যবস্থা নিচ্ছে – এমন পালটা প্রশ্নেরই মাধ্যমে, মণিপুর-প্রসঙ্গে স্মৃতি ইরানি বিরোধী রাজনীতিক ও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। এই আচরণে এতটুকুও কুন্ঠা বা লজ্জা তাঁর মধ্যে প্রকাশিত হয়নি। শেষ অবধি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির তরফে যখন সরাসরি মন্তব্য করা হল, “অন্যান্য ঘটনার সঙ্গে মণিপুরের ঘটনাবলীকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। অন্যান্য ঘটনাগুলি একক ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা। মণিপুরের ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের নারীদের উপর নির্দিষ্ট ও লাগাতার আক্রমণের ঘটনা দেখা গিয়েছে। এগুলি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার প্রমাণ,” তার পরবর্তীতে অবশ্য শ্রীমতি ইরানির তরফে আর কোনও সুস্পষ্ট প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। আবার অন্য একটি সূত্র থেকে শুনলাম আদালতের লিখিত নির্দেশে নাকি প্রধান বিচারপতির এই পর্যবেক্ষণকে ‘কারোর হুকুমে (?)’ কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। রাজনীতির অলীক-কুনাট্য-রঙ্গে আরও কত অবিশ্বাস্য ঘটনাকেই যে প্রত্যক্ষ করতে হবে, বলতে পারি না।
সংসদে বলতে উঠে যে ভাষায় ও বাচনভঙ্গিতে শ্রীমতি ইরানি বিরোধী রাজনীতিকদের দিকেই আক্রমণ শানিয়েছেন, তা এই সময়ে দাঁড়িয়ে কেবল যে অসাংবিধানিক ও অভূতপূর্ব তাই নয়, সেই আক্রমণ সর্বোপরি রুচিহীনতার পরিচায়ক। সম্পূর্ণ অনায়াস ভঙ্গিতে কেবলই রাজনীতিকদের মেঠো বক্তৃতার ধরনে বিরোধীপক্ষকে আক্রমণ করতে গিয়ে তিনি মণিপুরে হিংসা ছড়ানোর কারণ হিসেবে রাহুল গান্ধীকেই দায়ী করে বসেন। অযৌক্তিক ও অশালীন আক্রমণ, চিৎকার ও অপ্রয়োজনীয় whatabouteryতে সাজানো তাঁর প্রথম বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় সরকারের বশংবদেরা এতটাই প্রসন্ন হন, যে চলতি সপ্তাহে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আনা বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাবের উপর আলোচনার সময়েও, শ্রী রাহুল গান্ধীর ভাষণের পরবর্তীতে জবাবি বক্তা হিসেবে শ্রীমতি ইরানিকেই বেছে নেওয়া হয়। এই ঘটনাই পরিষ্কার করে দেয়, মণিপুরের হিংসার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যে কেবলই নির্লজ্জ তাই নয়, এমন সময়েও বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, সস্তা, মেঠো প্রচার কৌশল, লাগাতার ব্যক্তিগত আক্রমণ করে প্রসঙ্গ এড়ানোর চেষ্টা ও সুযোগ পেলে কেবলই সাম্প্রদায়িক প্রসঙ্গ টেনে এনে হিংসায় উসকানি দেওয়ার নীচ-কৌশলেই কেন্দ্রীয় সরকার আস্থা রেখে চলেছে।
আমাদের এই সময়ে দাঁড়িয়ে তাই কেবলই হতাশ হয়ে ভাবতে ইচ্ছে হয়, এদেশেও নারী ও শিশুকল্যাণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে দেখার প্রয়োজনে আলাদা একটি মন্ত্রক বা দপ্তর রয়েছে। সেই দপ্তরের প্রয়োজনে পূর্ণসময়ের একজন মন্ত্রী অবধি রয়েছেন। কিন্তু দেশের এই ভয়াবহ সময়ে, যেখানে প্রতিমুহূর্তে নারীর অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, ও দেশের একটি অঙ্গরাজ্যে নারীর সম্মান কার্যত সংঘর্ষে জিতে নেওয়ার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই সময়ে দাঁড়িয়েও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর তরফে কেবলই whatabouteryরই উদাহরণ প্রদর্শিত হয়ে চলেছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে কিছু মানুষের তরফে সামান্যতম সহানুভূতি (empathy) ও সহমর্মিতা (compassion)কে আমরা যারা দেখব বলে এতটুকুও আশা করেছিলাম, আমাদের তরফে তার সবটুকুই বোকামির লক্ষণ ছিল বোধহয়।
অমৃতকালের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, সহানুভূতি অথবা সহমর্মিতার সমস্ত প্রতিশব্দকেই, বোধহয় আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত।
0 Comments
Post Comment